Sunday 17 November 2013

Hygiene care - অর্পিতা বাগচী


Hygiene care
-অর্পিতা বাগচী

“ইস, এতো ভাল শাড়িটা ! কি গো তুমি? একটু নিজেকে সামলাও। এতো বেখেয়ালে হলে চলবে? যাক যা হবার হয়েছে। মন খারাপ ক’রো না। Hygiene care-এ দিয়ে দিও।“
বলে,সোহিনী আর তার একরত্তি মেতে টা টা ক'রে হাঁটি হাঁটি পায়ে চলে গেলো।
সত্যি, কি করে যে করলাম ! আমি? বড্ড আনমনা হয়ে যাচ্ছি আজকাল।
এবার পুজোর সব থেকে ভাল শাড়ি। খুব পছন্দ হয়েছিল। অবশ্য কাঞ্জিভরাম আমার সবসময়ের পছন্দ। Hygiene Care তো আছেই। মনে মনে এই সব ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে চায়ের জল চাপাতে গিয়ে সামনের জানালাতে দেখি, লক্ষ্মী পুজোর চাঁদটা আজ এখনও আসেনি, শীতটা ক্যামন আসছি আসছি করছে, অনেক দিনের পুরনো বন্ধু যেন, আসবো বলেও আসছে না। চারিদিক ক্যামন নিস্তব্ধ, থমথমে।
এ বাবা !  কি যে করছি না আজকাল, ওড়নাতেও! এখনি না ধুলে আর যাবে না। কিন্তু এ কি রে বাবা ! কলতলাতে ওড়না ঘসেই যাচ্ছি আর লাল নীল আরও কতো রঙ বেরিয়েই যাচ্ছে । আর আজ সকালের শাড়িটা? মনে পরা মাত্রই, ঠিক তাই। কিন্তু আমার শাড়িতেই বা ক্যানো? আমি তো সামলেই থাকি। গুছিয়েই রাখি, তা হলে কি করে হল এ্যামন?
“বৌদি, টাকা দাও। বাজারে না গেলে রান্না হবে কি? কিছুই তো নেই গো।”
প্রতিমার ডাকে হুঁশ ফেরে। সত্যি তো কিছুই নেই। সকালেই দেখেছিলাম, কি যে হয়েছে আমার, কিচ্ছু মনে থাকে না।
“দাও, দাও আমার আবার ও বাড়িতে এতো রান্না করতে হবে। বাচ্চাটার জন্মদিন।’’
ওর তাড়া শুনে তাড়াতাড়ি টাকা বার করতে গিয়ে প্রতিমার আঁচল আমার নোয়াতে
আটকালো। 
“কি গো আমার আঁচল ছাড়ো, আমার আঁচলে কি খুঁজছো?”
তবু ভাল ওর আঁচলে নেই। কিন্তু আমার আঁচলেই বা কি করে হল?
আলমারি খুলে টাকা বার করছি, আরে এ কি কাণ্ড? প্রতিমা ও প্রতিমা
 আমার চিৎকারে ও প্রায় আসতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিল, কোন রকমে নিজেকে সামলে,
“কি গো, কি হল?”
‘‘দ্যাখোনা, দ্যাখো আমি টাকা বার করতে যেই আলমারি খুলেছি আমার সব সবকটা শাড়ি এক এক করে ঘরময় উড়ে যাচ্ছে আর সব শাড়ির আঁচলে দাগ।
কি করে এমন হল প্রতিমা? কি করে! আমি তো গুছিয়েই রাখি, সামলেই থাকি। 
তুমি Hygiene care চেনো প্রতিমা? বলো না, চেনো না?’’
“তুমি এমন ক’রো না আর শাড়িগুলো তো ঠিকই আছে, আমি বরং পাশের বাড়ির বউদিকে ডেকে আনি।’’
আমার ঘরে আমাকে একা ক’রে দিয়ে প্রতিমা বেরিয়ে গ্যালো ।
সেই গান আবার, এক গান গত দুদিন ধরে বেজেই চলেছে,
লাগা চুনরিমে দাগ ছুপাঁউ ক্যায়সে? ঘর যাঁউ ক্যায়েসে..


অসুস্থ জানলা -রোহণ ভট্টাচার্য



অসুস্থ জানলা

-রোহণ ভট্টাচার্য

বাইরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কাঁচের জানলা। সামান্য শব্দটুকুও বেরোতে পারবে না বাইরে। যদি আলো হয় তবে কাঁচ ভেদ করে বাইরের উঠোন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। অথচ এইসময়, ঠিক এইসময় আলোহীন শব্দই লিখতে ইচ্ছে করে ওর। ঘরের ছাদ থেকে বইয়ের তাক পর্যন্ত ধুলো। ধুলো সরিয়ে শব্দটা খুঁজে পেতে হবে। তোষকের নিচে বা বইয়ের ভাঁজে কোথাও একটা লুকিয়ে আছে শব্দটাসেই নীল হরফের শব্দ সারা গায়ে একটা সাদা কাগজ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে এই ঘরের মধ্যে। দরজা-জানলা বন্ধ তাই উড়ে পালাতে পারেনি কোথাও।

জানলার ওপাশে গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে। বৃক্ষজীবন ত্যাগ করে একেকটা পাতা এগিয়ে চলেছে মাটিজীবনের দিকে। গাছ থেকে ছিঁড়ে মাটি অবধি যাওয়ার সময় পাতাদের জড়িয়ে ধরে আদর করে হাওয়াএলোমেলো হাওয়ার শরীরে পাতারা ভরে দেয় খসে পড়ার গান। সেই থেকে সকল খসে পড়া, সকল চলে যাওয়ারা হাওয়ার সন্তান। সদ্য জন্মানো শিশু যেমন কেঁদে কেঁদে মাকে ডাকে; ঠিক সেইভাবে বিচ্ছেদ জন্মালে তার কান্না দীর্ঘশ্বাস হয়ে হাওয়ার কাছে যায়। ঘরের ভেতর এইসময় ডাইরির পাতারা নড়ে ওঠে। একবার সেলাই খুলে ছিটকে আসতে পারলেই দুপাশের পৃষ্ঠা দুটো মেলে দেবে পাখির ডানার মতো। অথচ তারা বেশিদূর উড়তে পারে না। অক্ষরের ভারে অকেজো হয়ে গেছে ডানা। হয়ত উড়ে যাওয়া বিষয়ক কিছু একটাই লেখা ছিল সে পৃষ্ঠায়...

ঘরের ভেতর, কাঁচের এপাশে হারিয়ে যাওয়া কাগজটা খুঁজছিল যে; এতক্ষণ সে দেখছিল এইসব। দেখছিল ওপাশে কিছু দূরে আরেকটা জানলাসেই জানলায় মেঘ আসত না। কিন্তু মেঘের রাজ্য পেরোলে যে দেশ সেখান থেকে টেলিগ্রাম আসত আর আসত একটা চড়ুই পাখি যার পায়ে বেঁধে রোদ্দুর চিঠি পাঠাত ওই জানলায়। এপাশের জানলা থেকে সে বহুবার বলতে চেয়েছে


আমার চিঠি নেই। সারাবছরের অসুখ আছে। পুরোনো অসুখে জমানো ধূলো আছে ঘরময়। সেই ধূলোর গায়ে আঙুল বুলিয়ে আমি জানলা জুড়ে স্মাইলি আঁকছি তোমার জন্য।


ওর জানলা দিয়ে এয়ারপোর্ট দেখা যায় না, শুধু উড়ে যাওয়া দু-একটা প্লেন দেখা যায়। প্লেনের ছায়া এসে উল্টোদিকের জানলার কপাটে পড়লে কেমন লাগে দেখার চেষ্টা করে। বাইরে তাকিয়ে ওর মনে হয় যেন একটা গাছ চরিত্রে অভিনয় করছে সে। পাতার বদলে গাল বেয়ে জলের ফোঁটা ছিঁড়ে পড়ছে মাটিতে। আছড়ে পড়ার তীব্র আওয়াজে ভরে যাচ্ছে ঘরটা। তবু কাঁচ ভেদ করে ওপাশে যেতে পারছে না কিছুতেই। প্লেনের দিকে তাকিয়ে ওর মনে পড়ে, ওখানকার কোনো এক যাত্রীর জন্য সাদা কাগজে আলোহীন একটা শব্দ লিখেছিল সে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া কালিতে। এখন কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে জানলার ধুলোয় হাত বুলিয়ে আরেকটা মৃদু হাসিমুখ আঁকল। তারপর আদর করার ভঙ্গিতে কাঁচটা সরিয়ে দিতেই হুহু হাওয়া এসে ধাক্কা খেতে লাগল অসুখের ওপর, ফাঁকা ওষুধের পাতাগুলো ভেসে গেল এদিক ওদিক। বাইরে গাছের গায়ে পিঁপড়েরা তখন আরেকটা নতুন নক্সা আঁকছে।

ফুল - প্রলয় মুখার্জি




ফুল
 -প্রলয় মুখার্জী

মেয়েটাকে ছেলেটা বলেছিল এটা ফুল। এরকম বিচ্ছিরি ফল জুড়ে ওরা ক্রমশ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একটা খোলা মাঠে ওরা এখন মাঠে বসে আছে অনেক খানি ফাঁকায়। এই ফাঁকাটাই ওদের আলাদা ভরা যত্ন। মেয়েটা হাসে আর দ্যাখে ওর ভালো লাগা মেয়েটাকে হাসাচ্ছে।খুব বিচ্ছিরি হাসি, এমন কেউ ভেবে বসলেই হবে। চোখ বন্ধ করে বার বার ভাবো খুব বিচ্ছিরি হাসি। খুব মনে আসে খুব বিভৎস যন্ত্রণা গানের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আর একবার অন্ধকার নির্জন নির্জনে তীব্র কল্পনা নামছে। চোখে মুখে কল্পনা এমন যে মানুষের মুখ না। মেয়েটার মুখে বুড়ো মোষের মুখ লাগানো, যে মোষটা প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কি তীব্র যন্ত্রণার মুখ আহা মেয়েটা হাসছে। হ্যাঁ দেখতে ভালো নয় ছেলেটার মুখ তোমরা কেউ দ্যাখোনি। মেয়েটা তখনও হাসছে খুব। এই মুহূর্তে খুব ভুলে যেতে ইচ্ছে করে মোষের মুখ। যেমন দুজন ভালবাসে মানুষের মুখ। যেমন মোষের মুখ মানুষের গর্দানে দেখতে ভাল নয়। আবার দ্যাখো একটা ছেলে দেখতে ভাল নয় একটা মেয়েকেই ভালবাসে। পাখিটাও দেখতে ভাল নয় যে নাকি সাক্ষী ছিল। এমন এক গাছের ফুল ফুটেছিল যা নাকি অসুখের পরাগরেণু। কি আশ্চর্য, দেহ ছাড়া আমরা মুখ ভালবাসি। দেখতে ভালো না মানে দেহ ছাড়া একটা মুখ। দ্যাখো এতক্ষণ এতক্ষণ দুজন চুমু খেলো। ভুলে গ্যাছো কি ভয়ঙ্কর দুজন ভালবাসে? এখন ভালবাসা শোনো, কান পেতে সবচেয়ে তীব্র ভালবাসা। আমি বিশ্বাসঘাতক শুনে তোমরা কি করবে? কি করবে শুনে ছেলেটার বা মেয়েটার ধরে কোনো মুন্ডু ছিলনা। এমন কিছু হাসি আছে যেখানে মুখ নেই। কি আশ্চর্য দ্যাখো গলাকাটা দুটো ছেলে মেয়ে তবু দুজনকে জড়িয়ে ধরছে। আর যারা মুখ দেখে বলি ফুল সুন্দর, ডানা দেখে পাখি তারা কি ভীষণ যন্ত্রণা পাচ্ছে ছেলেটা বা মেয়েটাকে সুন্দর বা বিচ্ছিরি না বলতে পেরে। শুধু ভয় পাচ্ছে । কি বিচ্ছিরি ভয়। আর মাথাকাটা দুটো ছেলে মেয়ে বলছে তোমরা তোমাদের সবচেয়ে সুন্দর মুখ গর্দানে বসিয়ে নাও।

Saturday 2 November 2013

ক্ষুধার্ত আয়না ও একটি পাখি - তন্ময় ধর

ক্ষুধার্ত আয়না ও একটি পাখি
                     -তন্ময় ধর


পাখিটা আয়নার খুব সামনে এসে শত্রু চিনতে থাকে। পারা-ওঠা আয়না। পাখির অসুবিধে হচ্ছে শত্রুর শরীরাংশ চিনতে। তাই পাখিটা ওর শৈশবের দিকে উড়ে গিয়ে ঠোক্কর মারে আমার মৃত, রাসায়নিক আঙুলে। পাখির করুণ ডাক আমার বাবা-মাও শুনেছিলেন। আমার অসাড় আঙুল ধরে ওঁরা টেনে নিয়ে চললেন।বর্ণান্ধ নীল আলো, বেগুনী আলো, লাল আলো- সব পার হয়েআমার অবশ আঙুলের ঠেলায় আয়নায় পারার প্রলেপ গাঢ় হচ্ছে।

আমার মৃত চোখ একেকটা অঙ্গের প্রেমে পড়ে। পারার কমলা রঙে ভিজে থাকা একেকটা অঙ্গ, যাদের আয়ু নেই, ছাঁচ নেই, সৌকর্য্য নেই। বিকৃতির একটু আগে যেন হেসে ফেলেছে। আমার আঙুল পেরিয়ে যায় কারো নখের বর্ণমালা। নরম নখ।পাখিটা এবার অন্যদিক থেকে উড়ে আসে।

কেউ কথা বলছে। আমাকে ডুবিয়ে-রাখা তরলের ভেতর থেকে কেউ পাখিটার স্বর নকল করছে। আমার ভ্রূমধ্যে নখের ছাপ ফেলে পাখি। পালকের গহন ঘ্রাণ থেকে প্রতিসরাঙ্ক কমাতে কমাতে পাখির মৃতদেহের সাথে আকাশযুদ্ধ শুরু করি আমি।

পাখিটার কঙ্কালতন্ত্র পরীক্ষা করতে করতে স্বচ্ছ এক ঈশ্বরের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। আকাশের অস্তিত্ব আছে কি?মেঘমন্দ্র এক স্বর থেকে আমার শরীরে আশ্চর্য্য ডানা তৈরি হয়। শাদা পালক। শাদা নৈঃশব্দ্য। আর আবহমন্ডলের তাপমাত্রা হু-হু করে কমে যাচ্ছে।

আলো-অন্ধকারের অস্তিত্ব আছে কি? পৃথিবীর আদিম এক কোষবদ্ধ জীবনের ভেতর থেকে আমার কান্না শুনতে পাই আমি। কেঁপে কেঁপে ওঠা কান্না। খোলস ফাটিয়ে বের হয়ে আসি আস্তে আস্তে। দেখি, পাখিটা নিশ্চিন্তে বসে ঠোঁট দিয়ে পালক পরিষ্কার করছে। আমি অপেক্ষা করে থাকি। আমার দিকে একবার তাকায় পাখি। তারপর আয়নার দিকে তাকায়।

আয়নাটা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়তে থাকে। খুব ধীর প্রক্রিয়ার ভেঙে পড়ছে একেকটা কাঁচের টুকরো। আস্তে, খু-উ-ব আস্তে। পাখিটা এই ভাঙনপ্রক্রিয়া দেখতে ব্যস্ত। আমি এ সুযোগে ওর ডিম চুরি করে পা বাড়াই বিকেলে স্ন্যাকসের দিকে। নতুন নখের ছাপ পড়ে তরলীকৃত বাতাসের গানে গানে। টিউ টিউ টিউ ...




Sunday 27 October 2013

কবীরা - অনিমিখ পাত্র



কবীরা
-অনিমিখ পাত্র

    অনেকদিন বাদে কবীরার দেখা পেলাম। অথচ একটা সময় ছিল যখন তাকে অন্ধের মতো ফলো করাই ছিল আমার কাজঅবশ্য ফলো শব্দটা বোধহয় ঠিক হল না। অন্ধরা ফলো করে না। অনুধাবন করতে করতে যায়। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ভলিয়ুম বাড়িয়ে তুলে তারা বুঝতে বুঝতে যায়। তাদের মনোযোগ আমাদের থেকে বেশি। হ্যাঁ,এইবার ঠিক হল- কবীরার প্রতি আমার ছিল মনোযোগ। তখন আমি সিগারেট খেতাম না। মদ খেতাম না। এখন অনেক দায়িত্ব হয়েছে আমার। কবীরাকে কবিতার ছলশব্দ ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। কবিতার সঙ্গে তার তেমন কোনো অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। কবিতা তো আগেও ছিল।

    ব্যাঙ যেমন প্রায় গোটা শরীরটা জলের ভেতরে রাখে, শুধু চোখসমেত মুন্ডুর সামান্য অংশ জলের ওপর হাওয়ামহলে, কবীরা তেমনি করে চারপাশের দুনিয়া ও আমার জীবনটাকে দেখে। তার সঙ্গে যখন ঘোরাঘুরি করি আমি, তার জলের জগতে, আস্তে আস্তে অন্য সব শব্দের প্রাণ কমে যেতে থাকে আমার কাছে। যেন টিভি উচ্চগ্রামে চলতে চলতে মিউট হয়ে গেছে। বা অনেকটা ঐ সাসপেন্স মুভির মতো,রহস্যের তুঙ্গ মুহূর্তে, যখন কিছু একটা তুল্যমূল্য ঘটবে ঘটবে করছে, নায়ক পা দিতে যাচ্ছে কোনো ফাঁদে, চারদিক থমথম করছে, ভয় বাড়ছে একটু একটু করে, বিপদ আছে কাছেপিঠেই ওৎ পেতে কোথাও কিন্তু কিছু আপাতচোখে ধরা পড়ছে না, তেমন সময়ে যেমন একটা গুম্‌ম্‌ম্‌ গুম্‌ম্‌ ... ভোঁতা একটা ঢিবঢিবে একটা আবহসুর দেওয়া হয়। আমি সমস্ত শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার মনোযোগ তো কবীরার কাছে। এই যে এতোরকমভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি, সে আমাকে অনেকবার বারণও করেছে। রাগারাগিও করেছে বই কি! সে বলে, মাটির শক্ত মানুষেরা হাওয়ার ফুরফুরে মানুষেরা কী করে বুঝবে তোমার কথা! তারা তো কেউ আমাকে দেখেনি! তুমিই না হয় তাদের দিক থেকে, তাদের যুক্তি দিয়ে একটু ভেবে দেখার চেষ্টা করো। এই যে এতো অন্ধ অন্ধ করো, উপমা দাও, তুমি কি সত্যিই কখনও বুঝবে অন্ধ কেমন করে তার জীবনটাকে দেখে? রাস্তাঘাটের মানচিত্র তার কাছে ঠিক কিরকম? তার দৃষ্টি নেই বলে তার আর কি কি নেই আর কি কি আছে? আর তাছাড়া তুমি নিজেই তো মধ্যে মধ্যে দীর্ঘকাল আমার থেকে দূরে থাকো, মনেই করো না, তাহলে? কবীরাকে সম্ভবত ঈষৎ অভিমানী দেখায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে আবার বলতে থাকেঃ আচ্ছা, বলো তো,এই যে তোমরা এতো বুক বুক করো... কি না, বুকের ভেতরে আবেগ জমে আছে... সত্যিই বুঝতে পারো বুকের ভেতরকে? বুকেরই ভেতর সবসময় থাকে আবেগ? কতো ভেতরে? তা, ডাক্তারেরা ধরতে পারে না কেন? আমি আর কিই বা বলবো, শুধু ঠাহর করতে পারি কবীরা আমাকে ক্রমশ জাঁকিয়ে ধরছে। সে বলে, আমি সবসময় তোমাকে লক্ষ্য রাখি। তুমি জানবে, তোমার যখন আমার কথা মনে পড়ে না, দীর্ঘকাল ভুলে যাও জলের জীবন, তুমি জানবে তুমি শুধু পালিয়ে থাকতে পারো মাত্র। আমি কিন্তু আছি। তুমি বড়জোর চ্যানেল পালটে ফেলোকবীরার কথাগুলোর শব্দমাত্রা কমতে-বাড়তে থাকে আমার কানে। দূর থেকে ভেসে আসা পুজোর মাইকের ঘোষণার মত। দম্‌কা হাওয়ায় তার ঘোষণা ডেসিবেল বাড়িয়ে ফেলে। আমি বলি, তুমি এমনভাবে বলছো কবীরা, যেন তুমি আমার গাইডিং স্টার, যেন আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল! তুমি তো জলের প্রাণী কবীরা! এসব তো তুমি নও! কবীরা হাসে। আমাকে এবার কথাগুলো বলতেই হবে এমন একটা জন্তু আমার মধ্যে ঠেলা মারে, আমি আরো অনেকের কবীরা! আমি যদি লেখাপড়া না শিখতাম,তুমি পেতে এসব কনসেপ্ট? তুমি জলেরই প্রাণী কবীরা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আমি জানি তুমি আমাকে অক্সিজেন নিতে দেবে। তবু এই গলা অবধি জলের ভেতর থাকতে থাকতে আমার শরীরে পচন ধরবে কবীরা। শ্যাওলা জমবে গায়ে। আমার ত্বক অন্ধ হয়ে যাবে। আমি বরং সাঁতার দিই,কবীরা, সাঁতার তো আমি জানিআমি সাঁতার দিতে থাকি। কবীরার চিৎকার শুনতে পাই পেছন থেকে, কেন তুমি মানুষের কাছে আমাকে ভিলেনের মত দেখাও? তুমি তো জানো আমি তা নই! তাকিয়ে দেখো তো! কেন অতো বোঝানোর চেষ্টা করো যে তুমি আর কবীরা এক নও ... ...  আমি প্রাণপণ সাঁতার দিতে থাকি। আপাতত এই সাঁতারই আমার গাইডিং স্টার। আমার গার্ডিয়ান এঞ্জেল। মাটিতে হাওয়ার পাড়ে পৌঁছবো কিনা জানি না। পেছন ফিরে দেখতে ভয় হয়। কিরকম দেখবো তার মুখ কে জানে! যদি মায়া হয়। স্মৃতি সততই সুখের- যদি সত্যি মেনে নিই!

হ্যাপি প্রিন্সেস - সাঁঝবাতি


হ্যাপি প্রিন্সেস
-সাঁঝবাতি

কুসুম
ভালবাসবো...
বলে কেউ মোমআলো জ্বালেনি কখনো
আমাকে জ্বালার মত যথেষ্ট অন্ধকার কারুর ছিল না...

সব অন্ধকার মাত্রই আলো জ্বালা যায় না। আমরা দুজন এক গা অন্ধকার নিয়ে আলো খুঁজে চলি। একজন খোঁজে ভালো আরেকজন খোঁজে বাসা। এদের মাঝখানে এক তেপান্তর শূণ্যতা থাকে। একজন মশারী টাঙানোর পার্টনার খুঁজে যায়, আরেকজন নিজেকে। বলেছিলাম, তোর সবচেয়ে ভালো ছবিটা আমিই তুলে দেবো। ক্যামেরায় চোখ রাখি। একা একা করতে করতে তোর যোনিতে জং লাগে, জংলাতে এসে একটা শিবলিঙ্গ রেপ করে যায়। নাহ্‌ বীর্যপাত হয় না। বীর্যপাত তো আমারও হয় না।  আমার কেবল নাইট ফল্‌স আছে। ঘুমের ঘোরে ধপ্‌ করে মাটিতে পড়ে যাওয়া। মাটির কাছাকাছি আসা মানেই তো কোল খোঁজা। খুঁজে পাই না, খুঁজে পাই না...মায়ের মত ভালো গান বাজতে থাকে।
আমি তোর থেকে নাইট্রোসান টেন শিখি। ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখি, তুই লাল জামা পড়া মেয়েটার হাত ধরে বিছানায় ধুকে যাস অথবা লোমওলা ছেলেটার বুকে। ওহ্‌ ঘুম, তুমি অর্ধনারীশ্বর। কুসুম, মন নেই বলেই তোমার শরীরের সবচেয়ে সুন্দরী ছবিটা ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারলাম; মন থাকলে তোমায় ধরতে গিয়ে, গলার ইভস্‌ অ্যাপেল কেঁপে যেত।   



 কৃষ্ণকলি
দেখেছিলাম আলোর নিচে : অপূর্ব সে আলো
 স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার,  পুড়িয়ে দিলো চোখ...

মনে আছে, আমরা সিটিসেণ্টারে যেতাম?  তার পাশে পলাশগাছটা কি আজও আছে? নাকি কৃষ্ণচূড়া ছিল? ঠিক মনে পড়ে না কারণ আমরা দুজন পা রাখা মাত্রই সমস্ত গাছগুলো লাল হয়ে যেত লজ্জায়। সেই লাল কখনও উঠে আসে সিঁথিময় তারপর ফোলাফোলা চোখে...লালেরা একই থাকে খালি জায়গা আর সময় বদলে যায়।
টুইঙ্কল খান্নাকে কেন টিকটিকি বল্‌তাম আমরা, সেই নিয়ে তুই তোর ফরসা বয়ফ্রেন্ডের সাথে হাসাহাসি কর্‌লি। সেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে তোর লালপ্যান্টির সম্পর্ক বেশিদূর গড়ায় না। আমিই গড়িয়ে গড়িয়ে নিচের দিকে নামতে থাকি। তোর কালো বরের সাথে বিয়ে হল। তুই মুখভর্তি ফাউন্ডেশ্‌ন, সাদা পাউডার ঘসে হাঁটাহাঁটি করিস সিটিসেণ্টারে।  
আমার গায়ে আগে কত হীরে জহরত আলো ছিল। আমার লাল নাইটিঙ্গেল পাখি একে একে সবাইকে  আমার গা খুবলে, মাংস খুবলে, সুখ খিদে ভাগ করে দিয়ে আসে। লোকে বলে কেন আমার মুখে এত দাগ? কেন আমি ওগুলো অপারেশ্‌ন করাই না? এখন আমি এদের কি করে বোঝাই, পুরনো সুখগুলো কলঙ্ক হয়ে ফুটে আছে চাঁদে। কুছ দাগ; হুম, আচ্ছা হ্যায়। নাইটিঙ্গেলকে বলি, গাবলুস, যাও এই চোখটা উপড়ে নিয়ে ওর কাছে দিয়ে এসো। ওর এবার আলো দরকার। এতদিন বেচারী চাপচাপ অন্ধকার খেয়ে গা ভর্তি কালো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালোরঙের জন্যে ওর ঘেন্না দেখলে মায়া হয়।  
নাইটিঙ্গেল বলে, তোর খালি এই একটাই চোখ বেঁচে আছে। কপাল থেকে তিননম্বর চোখটাও খুবলে নিলে অন্ধ হয়ে যাবি। ওকে বলি, মুগ্ধ হয়ে জ্বলে মরে যাওয়ার চেয়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো। নাইটিঙ্গেল শেষ হীরেটাও উপড়ে এনে তোর কাছে দিয়ে আসে (যদিও সিনেমাটিক, তবুও মণিরত্নম...কারণ যশ চোপড়া হতে গেলে হাজার হাজার ওয়াট হতে হয় )কিন্তু আমি তখনও দেখতে পাই। আমার চোখের সামনে ধ্যাবড়া মোটা সাদা ফ্যাকফ্যাকে একটা আঁশটে টিকটিকি ফটফট করে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। মুখের মধ্যে অর্ধেক ওগড়ানো একটা পুরুষ মানুষের ঠ্যাং। প্রেমে অবৈধতায় না ঘেন্নায় বুঝে উঠতে পারি না। আমার ওয়াক উঠে আসে...     


ঘোলাজল - নীলাদ্রি বাগচী


ঘোলাজল                
-নীলাদ্রি বাগচী

খণ্ডাংশের কাছে উৎসমুখ চেয়ে চলেছে সারাজীবন। ভাঙা আয়নায় দাড়ি কাটতে কাটতে এইটেই বারবার মনে হয়। তখন বাথরুমের জলের আওয়াজ আর রান্নাঘরের নানারকম থেকে কান উঠে যায়। মন যেন গিয়ে দাড়ির গোরায় আসলে সময়ের স্বল্পতায়। এর পর স্নান তার পর খাওয়া আর তারও পর। এইসব ভানায় আটকে যায় জলের আওয়াজ রান্নার নানারকম।

বালতি থেকে মাথায় জল ঢাললেই ঘোলা বাল্বের বাথরুম সাদাকালো টেলিভিশন। চুন বালি খসা সিমেন্ট বাঁধানো দেয়াল চোখের সামনে, গলায় বেসুরো দু এক লাইন। খানিক উহুহুহু হুস উহুহুহু। আর ঝপ ঝপ জলের আওয়াজ। সাদাকালো জলের অবিরল ততক্ষণ যতক্ষণ না শরীর আধভেজা রেখে পোশাক চড়ান। তারপর পৃথিবী আবার রঙিন। কিন্তু ঠিক মানুষটা যেন নেই।

মানুষটা সামান্য ওপরে সিলিং ফ্যান আর ধোঁয়া টেবিলের মাঝামাঝি চিত উপুড় ভাসতে ভাসতে দেখছে টেবিল সে খাচ্ছে। চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি, হচ্ছে নাগরমে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। সে ভেসে ভেসে ফিরে যাচ্ছে অতীত। দাড়ি কাটা দেখছে, স্নানের জলের ছিটে লাগছে তার গায়ে। হাতায় মুখের জল মুছে সে ভাসতে ভাসতে আবার খাবার দৃশ্যে। তারপর বাইরে।

একবারে ভবিষ্যতে। যখন সে আবার ফিরে এসে থিতু হল জানলার পাশের মানুষে। বাস চলছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে। ড্রাইভার কন্ডাক্টরর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এই ঢিক ঢিক। লোক গাল দিক না দিক একই গতি। মেঘলা, গুমোট দিন। এতক্ষণে শিয়ালদা।

গয়নার দোকান বললেই বউবাজার। সারসার কাচে অজস্র। সে আবার ভেসে যায় কাচের পাশে পাশে। এত গয়না মানে কত মানুষ? কত কত কত মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে এই সব ঝিলিক। কত আয়নায়। কত চোখেই না ঝলমল করে উঠছে রূপ। রূপ না রূপের মোহ? স্বর্ণতৃষা?

সেন্ট্রাল এভিনিউ এলে আবার ফিরে আসে। দ্রুত হাঁটা ব্যস্ত রাস্তা। লেবুজল বিক্রি হচ্ছে। কাটা ফল। হরেকরকম। একেবারে কোণে ফুটপাথ ঘেঁষে জমা বর্ষার জলে শহর দেখছে শহরকে। কখন যেন মোড় ফুরল। আর ভাঙা চোরায় ঠোক্কর খেতে খেতে বাস ঠেকল কর্পোরেশনর সামনে। ওই তো ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে সব্বাই, সাদাকালো প্রেক্ষাপটে একঝাঁক উজ্জ্বল।


মাঝরাতে এতক্ষণে সে আবার ফিরল। মনে পড়ল তারপর চ্যাপলিনে ছিল রুদালি।